স্বভাব ও অভ্যাস

মহানবী হযরত মোহাম্মদ (সাঃ) সারাক্ষণ আল্লাহকে স্মরণ করতেন। তা তিনি যে অবস্থাতেই থাকুন না কেন? শয়নে-স্বপনে-জাগরণে, কাজে-কর্মে আল্লাহকে তিনি হাজির-নাজির জ্ঞান করতেন। কোন ধরনের বিপদ-আপদ, প্রাকৃতিক দুর্যোগ দেখা দিলে তিনি তাঁর সব কাজকর্ম বাদ দিয়ে আল্লাহর রহমত কামনা করে কেবলামুখী হয়ে ইবাদত-বন্দেগী করতেন। আল্লাহর প্রতি বার বার আনুগত্য প্রকাশ করতেন। আল্লাহর প্রতি ভয় ছিলো হযরত মোহাম্মদ (সাঃ)-এর সারাক্ষণের কাজ।
বিপদ-আপদে আল্লাহর প্রতি ভয় ও আনুগত্য প্রদর্শন আল্লাহর সৃষ্ট সেরা জীব হিসেবে আমাদের কর্তব্য। হযরত মোহাম্মদ (সাঃ) তাই বলতেন-‘আয় মাবুদ! আমি আপনার দেওয়া বিপদ হইতে আশ্রয় কামনা করিতেছি। আর যখন উপরোক্ত বিপদসমূহ দূরীভূত হইত, তখন তিনি নিশ্চিত এবং খুশি মনে আল্লাহর কাছে লাখো শোকরিয়া আদায় করতেন। যে কোন মুমিন, মুসলমানের হযরত মোহাম্মদ (সাঃ)-এর এই নজীর অনুসরণ করে চলা উচিত।
কথাবার্তায় সৌজন্য প্রদর্শন ছিলো হযরত মোহাম্মদ (সাঃ)-এর চরিত্রের স্বাভাবিক ও অনিবার্য অনুষঙ্গ। সকল কালের এই সেরা মানুষ ভদ্রতা, শিষ্টাচারে ছিলেন অনন্য। তাঁর এই চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য অনুসরণ করে আমাদের জীবন চলার পথে অগ্রসর হওয়া উচিত। তিনি কারো সহিত সাক্ষাৎ হলে তাঁকে সালাম জানাতেন, তাঁর সঙ্গে কুশল বিনিময় করতেন এবং আন্তরিকভাবে তাঁর সঙ্গে মোসাফাহা করতেন। কেউ তাাঁর সঙ্গে কথা বলতে চাইলে তিনি তাঁর কথা গুরুত্ব দিয়ে, মনোযোগ সহকারে, ধৈর্যসহকারে শেষপর্যন্ত শুনতেন, তিনি কোনো প্রকার বিরক্তি বা তাচ্ছিল্য প্রকাশ করতেন না। হযরত মোহাম্মদ (সাঃ) নিজে কারো সঙ্গে কথা বললে সংক্ষেপে বিনয়ের সঙ্গে স্পষ্টভাবে বলতেন। কোনো প্রকার ছল-চাতুরীর আশ্রয় নিতেন না। কারো বুঝতে অসুবিধা হলে একটি কথা একাধিকবার বলতেন। কথার মাধ্যমে কোনো প্রকার উম্মা, অহংকার কিংবা গৌরব প্রদর্শন করতেন না।
মুসলমানদের সঙ্গে কথা বলার সময় নিজেকে তিনি কখনোই প্রবর্তক মনে করে, দলপতি জ্ঞান করে কথা বলতেন না। সভা-সমিতিতে তিনি বিশিষ্ট কোনো স্থানে বসতেন না। নিজেকে অন্যের চেয়ে গুরুত্বপূর্ণ জ্ঞান করতেন না। কাউকে কোনো স্থান থেকে সরিয়ে নিজের সুবিধার জন্য সে জায়গায় বসতেন না। সভা-সমিতিতে কথা বলার সময় তিনি সকলের দিকে লক্ষ্য রেখে কথা বলতেন। যাতে সকলে মনে করতে পারেন, তিনি সকলকেই ভালবাসতেন, শ্রদ্ধা করতেন।
মহানবী হযরত মোহাম্মদ (সাঃ) কারো গৃহে প্রবেশ করার প্রয়োজন বোধ করলে প্রথমে বাহিরে দাঁড়িয়ে সালাম জানিয়ে গৃহকর্তার অনুমতি নিয়ে ভেতরে প্রবেশ করতেন। ঘরে প্রবেশ করে ভালো আসনে উপবেশন না করে সাধারণ আসনে আসন গ্রহণ করতেন। পথে চলার সময় অন্য কেউ সালাম দেয়ার আগেই তিনি সালাম জানাতেন। এমন কী বালক, মহিলাদেরও তিনি প্রথমে সালাম জানাতেন।
ওয়াদা পালনে হযরত মোহাম্মদ (সাঃ)-এর জুড়ি নেই। কোনো কাজের কথা কাউকে বললে, নিজের ক্ষতি হলেও ওয়াদা পালন করতেন। প্রয়োজনে কারো জন্য অনেক্ষণ অপেক্ষা করতেন। এ প্রসঙ্গে আবদুল্লাহ ইবনে আবিল হামসা বলেছেন- ‘আমি মক্কাতে রাসুলুল্লাহ (সাঃ)-এর নিকট হইতে একবার কিছু সামগ্রী ক্রয় করিলাম এবং কিছু মূল্য বাকী রাখিয়া কিছুক্ষণ পরেই আদায় করিয়া দিতেছি বলিয়া তাহাকে ক্রয়স্থলে বসাইয়া রাখিয়া অন্যত্র চলিয়া গেলাম। কিন্তু ঘটনাচক্রে আমি উহা ভুলয়া গেলাম। তিন দিন পর আমার একথা স্মরণ হইল যে, রাসুলুল্লাহ (সাঃ)-কে ক্রীত বস্তুর মূল্য দিবার জন্য বসাইয়া রাখিয়া আসিয়াছিলাম। আমি যখন সেখানে উপস্থিত হইয়া দেখিলাম, রাসুলুল্লাহ (সাঃ) অবস্থান করিতেছেন। আমাকে দেখিয়াই তিনি এরশাদ করিলেন, তুমি আমাকে বড়ই কষ্ট দিলে। এখানে বসিবার কথায় রাজি হইয়াছিলাম বলিয়া তিন দিন পর্যন্ত তোমার জন্য অপেক্ষা করিতে হইল।’
রাসুলুল্লাহ (সাঃ)-এর মতো নিরহঙ্কারী ব্যক্তি দ্বিতীয় আর কেউ নেই। কোনো প্রকার দম্ভ কিংবা অহমিকা ছিলো না তাঁর মধ্যে। যে কারো বিপদে ঝাঁপিয়ে পড়তেন, গরিব-ধনী নির্বিশেষে সকলের সঙ্গে একত্রে তিনি খাওয়া-দাওয়াসহ উঠা-বসা করতেন।
হযরত মোহাম্মদ (সাঃ) শত্র“-মিত্র নির্বিশেষে সকলের মঙ্গল কামনা করতেন। সকলের সঙ্গে সদ্ব্যবহার করতেন, শত্র“র অপরাধ ক্ষমা করে দিতেন। যে কেউ তাঁর কাছে সাহায্য চাইলে, নিজে না খেয়ে, নিজে না ভোগ করে সাহায্য করতেন। ক্ষমাশীলতা ছিলো হযরত মোহাম্মদ (সাঃ)-এর মহৎ গুণ। কোনো কিছু কেউ চাইলে, মজুদ না থাকলে অন্য সময়ে দেওয়ার অঙ্গীকার করতেন। এ প্রসঙ্গে পরম করুণাময় আল্লাহতালা বলেন- ‘হযরত মোহাম্মদ (সাঃ) সৎ স্বভাবের চরমসীমায় পৌঁছিয়াছেন।’ মানুষের জীবনকে সুন্দর, শান্তিময়, উজ্জ্বল এবং ইহকাল ও পরকালকে সাফল্যমন্ডিত করার জন্য সকল বিষয়ে তাঁর প্রয়াস ছিলো নিরন্তর।
লাজ-শরমকে হযরত মোহাম্মদ (সাঃ) ঈমানের অঙ্গ বলে জ্ঞান করতেন। তিনি ছিলেন লজ্জা-শরমের মূর্ত প্রতীক। এ প্রসঙ্গে হযরত মোহাম্মদ (সাঃ) এরশাদ করেন- ‘মানুষ যখন লজ্জা-শরম বির্জিত হয়, তখন সে যাহা ইচ্ছা তাহা করিতে পারে।’
সহানুভূতি ও সদাচার ছিলো হযরত মোহাম্মদ (সাঃ)-এর চরিত্রের স্বাভাবিক ধর্ম। তিনি যে কারো বিপদে দুঃখিত হতেন এবং সহানুভূতিশীল হতেন। সংযমী ও ধার্মিক লোকদের তিনি বেশি সমাদর করতেন।
তিনি সহায়-সম্বলহীন মানুষের প্রতি বেশি সহানুভূতিশীল ছিলেন। বিশেষতঃ এতিম, অনাথ, বিধবা, গোলামদের প্রতি তাঁর অকৃপণ স্নেহ ও ভালোবাসা ছিলো। এজন্যই পবিত্র কোরআনে তাঁকে ‘রাউফ’ ও ‘রাহীম’ খেতাবে ভূষিত করা হয়েছে।
শোক-দুঃখে তিনি অনিঃশেষ ধৈর্য্যরে পরিচয় দিতেন। অন্যের শোকে, দুঃখে তিনি ভারাক্রান্ত হতেন। কিন্তু, নিজের শোকে-দুঃখে কাতর হতেন না। তিনি সকলকে ধৈর্য অবলম্বনের জন্য পরামর্শ দিতেন।
নারীদের তিনি বিশেষভাবে মর্যাদা দিতেন। তিনি নারীদের কোনোভাবেই হেয়জ্ঞান করতেন না। তাঁর সময়ে নারীদের মনুষ্য মর্যাদাই ছিলো না। পুরুষগণ নারীদের ভোগের সামগ্রী এবং সেবাদাসী মনে করতো। কিন্তু, হযরত মোহাম্মদ (সাঃ) নারীদের যথোপযুক্ত মর্যাদা দিয়েছিলেন। নারীদের সামাজিকভাবে প্রতিষ্ঠিত করেছিলেন। তিনি নিজের স্ত্রীদের ভালোবাসতেন এবং তাঁদের কাজে সহায়তা করতেন। নারীদের তিনি যথোপযুক্ত শিক্ষাও দিয়েছিলেন।
রোগীর সেবা করা ছিলো হযরত মোহাম্মদ (সাঃ)-এর মহান ব্রত। তিনি রোগীদের সেবা করতেন, তাঁদের সান্ত্বনা দিতেন, সহানুভূতি প্রদর্শন করতেন সর্বোপরি তাঁদের সাহায্য করতেন। আল্লাহর কাছে তাঁদের রোগমুক্তির জন্য দোয়া করতেন। রোগীদের জন্য চিকিৎসা, ওষুধ, পথ্যের ব্যবস্থা করতেন। রোগী শত্র“ হলেও তার সেবা করতে তিনি কার্পণ্য করতেন না। সুসংবাদে তিনি খুশি হতেন। আল্লাহর প্রতি শোকরিয়া আদায় করতেন। কখনো কখনো আল্লাহর দরবারে সেজদায় পড়ে শোকরিয়া আদায় করতেন। যুদ্ধে বিজয়ী হলে তিনি তাকবীর ধ্বনি করে উঠতেন। অনেক দিন পর কারো সঙ্গে দেখা হলে তাঁর সঙ্গে আলিঙ্গন করতেন। আত্মীয়-স্বজন, পাড়া-প্রতিবেশীকে ডেকে তিনি যিয়াফত দিতেন।
প্রবাস গমনের সময় তিনি তাঁর স্ত্রীদের মধ্যে একজনকে সফরসঙ্গিনী করতেন। বৃহষ্পতিবার দিনটিকে তিনি প্রবাসযাত্রার জন্য উত্তম জ্ঞান করতেন। সকালে যাত্রা শুরু করতেন, বাহনে আরোহণ করার সময় তিনি উচ্চারণ করতেন- ‘বিসমিল্লাহি আল্লাহু আকবর।’
প্রবাস যাত্রাকালে তিনি ঘরের এবং আশে-পাশের মানুষদের কাছ থেকে বিদায় নিতেন। প্রবাস থেকে ফিরে সবার আগে মসজিদে গিয়ে দু’রাকাআত নফল নামাজ আদায় করে ঘরে প্রবেশ করে প্রথমে কন্যা ফাতেমা (রাঃ)-এর সঙ্গে দেখা করতেন। প্রবাসযাত্রা কালেও তিনি কন্যা ফাতেমা (রাঃ)-এর কেউ তাঁর সঙ্গে দেখা করলে তিনি তাঁর সঙ্গে হাত মিলাতেন, তাঁর জন্য দোয়া করে বলতেন ‘যাও, ফি আমানিল্লাহ। অর্থাৎ আল্লাহর নিকট সোপর্দ করলাম।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *